Dalit Samhati

হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার দাবি

সংহতি ডেস্ক: হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি, হিন্দু সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র, সংবিধান লঙ্ঘন করে সনাতন হিন্দু আইন সংস্কারের উদ্যোগ, হিন্দু সম্প্রদায়কে সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, আন্তর্জাতিকভাবে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে অপচেষ্টা চালানোর অভিযোগে ইংরেজি ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সঙ্গে জড়িত শাহীন আনামসহ সবাইকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছে সনাতনী ঐক্য পরিষদ বাংলাদেশ। কয়েকটি এনজিও এবং স্বার্থান্বেষী মহল দ্বারা সনাতন পারিবারিক আইন পরিবর্তনের অপচেষ্টার প্রতিবাদে ‘পারিবারিক আইনে পরিবর্তন নিষ্প্রয়োজন’- শুক্রবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত এক গোলটেবিল আলোচনায় এ দাবি জানানো হয়। গোলটেবিল বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক।

আলোচনায় অংশ নিয়ে হিন্দু ল ইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শংকর চন্দ্র দাস বলেন, মাহফুজ আনাম, শাহীন আনাম, অ্যাঞ্জেলা গোমেজ ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন আমাদের ধর্ম পরিবর্তন করতে চায়। অথচ আমাদের আরও কত সমস্যা আছে সেগুলো নিয়ে তারা কথা বলে না। আমাদের জন্য এত দরদ! কখনো তো শত্রু সম্পত্তি আইন নিয়ে কথা বলেননি। অথচ একটা মীমাংসিত বিষয় আমাদের হাজার বছরের সনাতন আইন সংস্কার করতে চান। এ আইনের কারণে তো আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের কারও কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তাহলে হিন্দু আইন কেন আপনাদের মাথাব্যথার কারণ হলো?

তিনি বলেন, আপনারা তো হিন্দুধর্মের কেউ নন। হিন্দুধর্ম বোঝেনও না। আসলে মাহফুজ আনাম আপনারা এ দেশ থেকে হিন্দু সম্প্রদায়কে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে নেমেছেন। আপনারা আবার ১/১১-এর মতো চক্রান্তে মেতে উঠেছেন। আপনাদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এ দেশের দেড় কোটি হিন্দু জেগে উঠেছে। মিথ্যা প্ররোচনা দিয়ে আপনারা কিছুই করতে পারবেন না। আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি বারবার চক্রান্তকারী মাহফুজ আনাম, তার স্ত্রী শাহীন আনাম ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সঙ্গে জড়িত সবাইকে দ্রুত গ্রেফতার করার জন্য। অন্যথায় কঠোর কর্মসূচি দেব আমরা।

অ্যাডভোকেট ডি এল রায়চৌধুরী বলেন, মাহফুজ আনাম, শাহীন আনাম ও মতিউর রহমানরা একসময় কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের আইন সংস্কারের নামে দেশকে অস্থিতিশীল করতে এখন তারা রংবাজি করছেন। তাদের মায়াকান্না দেখে বলতে ইচ্ছা করে ভাত দেওয়ার নাম নেই, কিল মারার গোঁসাই। এ কথা বললাম কারণ হিন্দু সম্প্রদায়ের আরও কত সমস্যা আছে সেগুলো নিয়ে কখনই কথা বলে না। অথচ তারা আসছে আমাদের আইন সংস্কার করতে! তিনি বলেন, মাহফুজ আনামরা আমাদের উসকে দিলেন; তাদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর পদক্ষেপ নেব। তা না হলে দুই দিন পর বলবেন হিন্দুদের লাশ শ্মশানে না নিয়ে গোরস্থানে নিলে ভালো হয়। না পুড়িয়ে মাটিচাপা দিলে ভালো হয়। এসব চক্রান্তকারীর বিদেশ থেকে নাম বিক্রি করে টাকা আনার পথ বন্ধ করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, তারা বলে বিদ্যমান আইনে হিন্দু মেয়েরা সম্পদ পায় না। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আবার বলে হিন্দু নারীরা তালাক চায়, বাস্তবতা হলো কোনো হিন্দু নারী তালাক চায় না। সিঁদুরহীন, শাঁখাহীন অহিন্দুরাই তালাক চায়। মাহফুজ আনামরা দেখে দেখে তাদেরই দলে ভিড়িয়েছে। অ্যাডভোকেট সুনীল রঞ্জন বিশ্বাস বলেন, হিন্দু আইন সংস্কারের সঙ্গে কতিপয় এনজিও সংগঠন, কয়েকজন নেত্রী ও কয়েকজন ব্যক্তি জড়িত। তারা বিপথগামী। এ লোকগুলো হিন্দু আইনের কিছুই জানে না। কিছুই বোঝে না। শুধু দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য এ আইন সংস্কারের কথা বলছে। তিনি বলেন, হিন্দুধর্মে ও শাস্ত্রে নারীদের সবচাইতে বেশি সম্মান দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে সেপারেশনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কিন্তু ডিভোর্সের কোনো নিয়ম নেই। কারণ ডিভোর্স হলে সন্তাদের কী হবে। তারা এখন বলছে হিন্দু বিয়ের পরিবর্তে রেজিস্ট্রেশন চালু করতে। এটা করলে তারা কালকে আবার বলবে এটা কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ। সুতরাং আইন পরিবর্তন করার দরকার নেই।

তিনি আরও বলেন, কতিপয় ইন্ধন দেওয়া ব্যক্তি ও নেত্রী সবাই চিহ্নিত। এখন তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। তারা যাতে আমাদের হিন্দুদের নামে বিদেশ থেকে কোনো আর্থিক সুবিধা না নিতে পারে এজন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।

বাংলাদেশ হিন্দু ল ইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট নারায়ণ চন্দ্র দাস বলেন, আমরা হাজার বছরের সনাতন হিন্দু আইনের সংস্কার চাই না। এজন্য আমরা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাব। প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে দুষ্টচক্রের বিষয়ে জানাব। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানাব।

অ্যাডভোকেট সুশান্ত কুমার বসু বলেন, সংস্কারবাদী ও চক্রান্তকারীরা হিন্দুধর্মে তালাকের দাবি তুলেছে। আমি তাদের বলছি আমাদের ধর্মে বিয়ের মন্ত্র আছে, তালাকের কোনো মন্ত্র নেই। তাই তালাকের ব্যবস্থা করা যাবে না। কোনোভাবেই করা যাবে না। তাই আজকে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে এখানে এসেছি।

তিনি বলেন, ১৯৯৯ ও ২০০০ সালেও এনজিও ও চক্রান্তকারীরা তৎপর হয়েছিল। তখন তারা ১০০ কোটি টাকা বিদেশ থেকে এনেছিল। হিন্দুধর্মে তালাক আইন পাস করাতে সে সময় তারা এর থেকে কিছু টাকা খরচ করে জোর চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু আমাদের আন্দোলনের কারণে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। এখন তারা আবার ষড়যন্ত্রে নেমেছে। সে সময়ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। এখনো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে তারা চুপ থাকে। এ ধরনের কোনো আওয়াজ তোলে না। কারণ তারা সবাই জানে আমরা সবাই আওয়ামী লীগের লোক। এজন্য আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তারা হিন্দুদের আওয়ামী লীগের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চায়। দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে বহির্বিশ্বে ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চায়। সুশান্ত কুমার বসু চক্রান্তকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

ইসকন প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক রুপানুগ দাস মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের রেজিস্ট্রেশন বাতিলের দাবি জানিয়ে বলেন, এ ধরনের সংগঠনের পরিচালকরা নানাভাবে মিথ্যাচার করছে হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে।

মহানগর উত্তর পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুধীর চন্দ্র দাস বলেন, হিন্দু আইন সংস্কারের নামে একটি বিশেষ মহল ও এনজিও চক্রান্তে মেতে উঠেছে। তাদের প্রতিহত করতে হবে।

সনাতনধর্মের সভাপতি কুশাল চন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, কিছু ব্যক্তি সব সময় সর্প হয়ে দংশন করে ওঝা হয়ে ঝাড়ে। হিন্দুধর্মের সংস্কার চাচ্ছেন যারা তারা এই প্রকৃতির লোক। হিন্দুধর্ম সংস্কারের নামে তারা আসলে এ দেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়।

অ্যাডভোকেট তাপস পাল বলেন, হিন্দু নারীর অধিকারের কথা বলে চক্রান্তকারীরা ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন হিন্দুদের দেশত্যাগের আয়োজন করছে। যাদের নিয়ে তারা আইন সংস্কারের কথা বলছে তারা আসলে হিন্দুধর্ম মানে না। তিনি বলেন, এটা নিয়ে অনেক বড় বড় পত্রিকা ও সম্পাদকরা গোলটেবিল বৈঠক করেছে। বৈঠকে তারা যাদের ডেকেছে তারা হিন্দু আইন মানে না। ধর্মশাস্ত্র মানে না।

ভক্ত সংঘের সাধারণ সম্পাদক অনিল পাল বলেন, চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলনের সময় এসেছে। সারা দেশে একযোগে আন্দোলনে নামব আমরা। এজন্য তিনি বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন।

বাংলাদেশ হিন্দু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সাধন কুমার মিশ্র কুচক্রী মহলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।

সাবেক সচিব রবিচন্দ্রন মালাকার বলেন, হিন্দুধর্মের আইন সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। এ প্রাকৃতিক আইনের বিরুদ্ধে যারা কাজ করছে প্রকৃতি তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবে। মানুষ মিথ্যা বলতে পারে। কিন্তু প্রকৃতি কখনো মিথ্যা বলে না। যারা মিথ্যা বলে হিন্দু আইন সংস্কারের কথা বলছেন তারাও শাস্তি পাবেন। তিনি বলেন, চক্রান্তকারীরা যে ডিভোর্স প্রথা হিন্দুধর্মে চালু করতে চাচ্ছে এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এটা চালু করলে আমাদের সন্তানের কী হবে তা তারা ভাবে না।

বাংলাদেশ হিন্দু সংস্কার সমিতির সভাপতি অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস গোলটেবিল বৈঠকে হিন্দু আইন সংস্কারের বিপক্ষে ও চলমান আইন বহাল থাকার পক্ষে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে বলেন, দেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ নানামুখী অত্যাচার, নিপীড়ন, নিগ্রহ-নির্যাতন ও ধর্মান্তকরণ তথা নিরন্তর অশান্তির মধ্যেই কালাতিপাত করছে; দেখেশুনে মনে হয় এর যেন কোনো অবসান নেই। এর পাশাপাশি আর এক উপদ্রব সৃষ্টি হয়েছে তা হলো হিন্দু আইন সংস্কারের অশুভ পাঁয়তারা। বিগত প্রায় পঁচিশ বছর যাবৎ একটি বিশেষ মহল এ অপতৎপরতা চালিয়ে আসছে। জানা মতে এ উদ্যোগটি প্রথমেই নেয় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। তারা বিভিন্ন সময় সভা-সেমিনার ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচারণা শুরু করে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী শক্তি জেগে ওঠায় তারা সহায়ক শক্তির অন্বেষণে থাকে। জুটে যায় কতিপয় এনজিও, যার কেন্দ্রে অবস্থান নেয় মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, যারা এ কাজে অর্থের জোগানদার হিসেবে ভূমিকা নেয়। সারা দেশে হিন্দু নারীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াতে শুরু করে প্রচার-প্রচারণা। একসময় তারা হিন্দু এলিটদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পর্যন্ত পৌঁছে যান তারা। তিনি তো হিন্দু আইন সংস্কারের প্রয়োজনসংক্রান্ত ঘোষণাই দিয়ে দিলেন। এর প্রতিবাদে সৃষ্টি হয়ে গেল ‘সনাতন ধর্মীয় সম্মিলিত পরিষদ’। শুরু হলো আন্দোলন তথা প্রতিবাদী নানা কর্মসূচি। তিনি বলেন, ভাগ্য ভালো যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথোচিত নির্দেশনা রাখলেন যা তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের সানুগ্রহ সাক্ষাৎদানের মধ্য দিয়ে জানা গেল। সনাতন ধর্মীয় সম্মিলিত পরিষদের নেতৃবৃন্দের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়ে দিলেন কোনো বিরোধিতা থাকলে হিন্দু আইনের কোনো সংস্কারে সরকার হাত দেবে না। এটি ছিল ২০১২ সালের ঘটনা। এরপর আবার ২০১৮-১৯ সালে ওই মহলটি তৎপরতা শুরু করলে আবার গঠিত হয় হিন্দু পারিবারিক আইন পরিবর্তন প্রতিরোধ কমিটি। এবারেও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একইভাবে জানিয়ে দিলেন আপনাদের বিরোধিতা থাকলে সরকার হিন্দু আইন সংস্কার বা পরিবর্তনে হাত দেবে না। কিন্তু এরা তো নাছোড়বান্দা। আবার জোরেশোরে শুরু করেছে। কারণ বিদেশি টাকার কিছুটা খরচ দেখাতে হলেও তো অপেক্ষাকৃত দুর্বল জনগোষ্ঠী সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে কাজ করে খরচ দেখানো যাবে।

সর্বশেষ